বিজয়া দশমী কোন `বিজয়`কে চিহ্নিত করে? এই দিনের তাৎপর্য কি? বিজয়া দশমী পালনের মহত্ব কি? “দশমী” কথাটির অর্থ কি? দশমী কে বিজয়া বলা হয় কেন? সমাজে বিজয়া দশমীর প্রভাব কি? : ‘বিজয়া দশমী’ কথাটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ ও মনখারাপ মিশ্রিত একটি অনুভূতি। দশমী এলেই বাঙালির মনে আসে মায়ের ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা। অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও একটা বছর। সাধারনত দুর্গাপুজোর অন্ত হয় দশমীর মাধ্যমেই। এই দিনেই মা দুর্গার প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। তবে এই দিনটিকে বিজয়া দশমী বলার সঠিক অর্থ আজও জানেন না অনেকেই। দশমীর তাৎপর্য অনেকেরই অজানা, জেনে নিন এর আসল কাহিনী.
Table of Contents
বিজয়া দশমী : তত্ত্ব
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় দেবী মহামায়াকে বিশ্বপ্রকৃতিকে, আদ্যাশক্তি দেবী যোগমায়াকে ব্রহ্মের শক্তিজ্ঞানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ব্রহ্ম তার শক্তি বলেই সগুণ হন এবং সগুণ হলে তিনি সৃষ্টিকার্যে ব্রতী হন। এই ব্রহ্মই সগুণ হয়ে পালন করেন এবং ধ্বংস করে ভারসাম্য রক্ষা করেন। ব্রহ্ম যে রূপে সৃষ্টি করেন, তার নাম ব্রহ্মা; তিনি যে রূপে পালন করেন, তার নাম বিষ্ণু এবং যে রূপে ধ্বংস করে ভারসাম্য রক্ষা করেন, তার নাম শিব। এক থেকে তিন আবার তিনে মিলে এক.
- [নতুন] Netaji Subhas Chandra Bose Biography in Bengali নেতাজির জীবনী
- [নতুন] Swami Vivekananda Biography in Bengali – স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী
আবার ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের এক-একটি শক্তি বা গুণের প্রতীক বা প্রকাশক হলেন একেকজন দেব বা দেবী। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দেবদেবীরা ঈশ্বর নন ঈশ্বরের এক-একটি গুণ বা শক্তির প্রতীক। যেমন ‘দেবী দুর্গা’। দেবী দুর্গা ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। আদ্যাশক্তি মহামায়া বা যোগমায়ার মধ্য দিয়েই ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ ঘটে। এ শক্তি ন্যায় ও সত্যেরও প্রতীক। তিনি অন্যায় ও অসত্যকে ধ্বংস করে ন্যায় ও সত্যের প্রকাশ ঘটান.
প্রাচীন হিন্দু পুরান কাহিনী
একবার মহিষাসুর নামে এক অসুর স্বর্গ ও মর্ত্য (পৃথিবী) দখল করে নিয়েছিল। দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে পরাজিত করে তাড়িয়ে দিয়েছিল স্বর্গরাজ্য থেকে। আর দেবতাদের উপায়ও ছিল না। দেবতা ব্রহ্মা মহিষাসুরকে এই বর দিয়েছিলেন যে, কোনো পুরুষ মহিষাসুরকে বধ করতে পারবে না। মহিষাসুর মনে করল যে, সে কার্যত অমর বরই লাভ করেছে। কোনো পুরুষ তাকে বধ করতে পারবে না তার ধারণায় কোনো নারী এত শক্তি ধরে না যে, সে মহিষাসুরের মতো এত বড় বীরকে হত্যা করতে পারবে।
কিন্তু এই বরের মধ্যে একটা ফাঁক ছিল। কোনো পুরুষ মহিষাসুরকে বধ করতে পারবে না কোনো নারী বধ করতে পারবে না, এমন বর তো দেওয়া হয়নি। অতঃপর সব দেবতার সমস্ত শক্তি সম্মিলিত হলো। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। তিনি মহিষাসুরকে বধ করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র ফিরে পেলেন তার স্বর্গরাজ্য। স্বর্গে ও পৃথিবীতে শান্তি ফিরে এলো। এ বিজয় থেকেই হলো বিজয়োৎসব। এরই নাম বিজয়া।
পৌরাণিক মতে
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে শ্বশুরবাড়ি কৈলাসে পাড়ি দেন দেবী দুর্গা। সেই দিনই বিজয়া দশমী পালন করেন মর্ত্যবাসী। এই দিনই প্রতিমা বিসর্জন করা হয়। পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনী অনুযায়ী, মহিষাসুরের সঙ্গে টানা ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করেন দেবী দুর্গা। শ্রীচণ্ডীর কাহিনী অনুযায়ী সেই এক টানা যুদ্ধের পর শুক্লা দশমীতে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। সেই যুদ্ধে জয়লাভকেই চিহ্নিত করে বিজয়া দশমী.
রামায়ণ অনুসারে
ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল রামের পত্নি সীতা দেবীকে। রাবণকে পরাজিত করে শ্রী রামচন্দ্র পালন করেন বিজয় উৎসব। এ থেকেও পালিত হয় বিজয়া। মহিষাসুরকে বধ করতে দেবীর যে যুদ্ধ হয়েছিল, তার মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল চার দিন। তিথির হিসেবে তিথিগুলো ছিল আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী। এ শুক্লা দশমী তিথিতে বিজয় হয়েছিল। এ জন্য এ আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিকেই বলা হয় বিজয়া দশমী। দুর্গাপূজার চার দিনের দিন দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে বিজয়া দশমী পালন করা হয়.
বিজয়া দশমীর দিন উত্তর ও মধ্য ভারতে আরেকটি উত্সব পালিত হয়, যার নাম দশেরা। তবে, বিজয়া দশমীর সঙ্গে এর তাত্পর্যে কোনও মিল নেই। দশেরা শব্দের উত্পত্তি সংস্কৃত শব্দ দশহর থেকে। এই দশহর রাবণের মৃত্যুকে চিহ্নিত করে। রামায়ণ অনুসারে আশ্বিন মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে রাবণ বধ করেছিলেন রাম। রামায়ণের এই কাহিনীও আজকের দিনের তাত্পর্য বৃদ্ধি করে.
মহাভারত অনুসারে
মহাভারত অনুসারে এই দিনের তাৎপর্য এর গুরুত্ব রয়েছে মহাভারতেও । ১২ বছর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে তাঁদের লুকানো অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন.
বৌদ্ধ ধর্ম মতে
বিজয় দশমীর সঠিক নাম অশোক বিজয় দশমী। মৌর্য সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে জয় করে যে বিজয় উৎসব দশ দিন ধরে পালন করেছিলেন, সেটাকেই অশোক বিজয়া দশমী বলা হয়। আর এই দিন সম্রাট বৌদ্ধ ধম্ম দিক্ষা নিয়েছিলেন। তাই এই দিন বৌদ্ধ ধম্মের পবিত্র উৎসব হিসাবে পালন করা হয়.
ঐতিহাসিক সত্যত্যা হচ্ছে, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর হিংসার রাস্তা ত্যাগ করে বুদ্ধ ধম্ম গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধম্ম গ্রহণ করার পর অনেক বৌদ্ধ স্থানে ভ্রমণ করেন। বুদ্ধের জীবন চর্চা করা ও সেটা নিজের জীবনে পালন করার কাজ করেন। আর তিনি বহু শিলালিপি, ধম্ম স্তম্ভ-এর নির্মাণ করিয়ে ছিলেন। সম্রাট অশোকের এই ধার্মিক পরিবর্তনে খুশি হয়ে দেশের জনগণ ঐ সব স্মারক বা স্তম্ভ সাজিয়ে দ্বীপ জ্বালিয়ে দ্বীপ উৎসব পালন করেন। এই আয়োজন খুব খুশি ও আনন্দের সঙ্গে দশ দিন পর্যন্ত চলে। আর দশম দিনে সম্রাট অশোক রাজ পরিবারের সঙ্গে ভন্তে মোজ্ঞিলিপুত্ত নিষ্প এর কাছে ধম্ম দিক্ষা গ্রহণ করেন.
বিজয়া দশমীর তাৎপর্য
হিন্দু শাস্ত্র মতে, দেবীকে পূজার জন্য আহ্বান করে এলে মাটির প্রতিমাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পূজা শেষ হলে দেবীকে বলা হয়, তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। তখন প্রতিমা থেকে তাকে মুক্ত করা হয়। তখন ওই মাটির প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। সুতরাং বিসর্জন নামে দেবী বা কোনো দেবের ধ্বংস নয়, যে মাটির প্রতিমাতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, সেখান থেকে মুক্ত করে, তাকে যথা ইচ্ছা চলে যেতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিসর্জন দেওয়া হয় না। দেব বা দেবীর প্রতিমা গৃহেই থাকে। পরবর্তী পূজার আগে (বছরান্তে) পুরাতন প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নতুন প্রতিমা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কাঠের প্রতিমা হলেও তা নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিবর্তন করা হয়। ধাতব কিংবা প্রস্তরের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় না। সেই স্থলে নিত্য পূজা করা হয়।
সুতরাং বিজয়া দশমীর তাৎপর্য হচ্ছে দুটি একটি দেবী দুর্গার বিজয়। অপরটি শ্রী রামচন্দ্রের বিজয়। রামচন্দ্র অকালে দেবী দুর্গার পূজা করে ছিলেন। রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা বাল্মীকির রামায়ণে নেই। তবে অন্য কবিদের রচিত রামায়ণে এবং পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বর্ণনা রয়েছে। দেবীর নিদ্রাকালে রাম তাকে জাগ্রত করেছিলেন বলে শরৎকালের দুর্গাপূজায় ‘বোধন’ নামক দেবীর জাগরণের একটি অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু বসন্তকালের দুর্গাপূজায় এ বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। তবে কেবল রামচন্দ্রই যে শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন তা নয়, শরৎকালে দুর্গাপূজার রীতি অনেক স্থানেই প্রচলিত ছিল।
বিজয়া দশমীর আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে। হিমালয় রাজকন্যা দেবী দুর্গা বা পার্বতী বা উমা নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছিলেন দেবতা শিবকে। শিবের আবাসস্থল কৈলাস পর্বত। সেখান থেকে দেবী দুর্গা বা পার্বতী পিতৃগৃহে আসেন। আশি^ন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিন পিত্রালয়ে থাকার পর দশমী তিথিতে পতিগৃহ কৈলাসে প্রত্যাবর্তন করেন। কন্যাকে বিদায় জানানোর বেদনায় বিধুর হয়, বিষাদাচ্ছন্ন হয় দশমী তিথি। তাই দশমী তিথি বিষাদের বেদনার।
‘দশমী ‘ কথার অর্থ কি?
‘দশমী’ কথাটির সাধারন অর্থ খুবই সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে পিতৃ গৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন দেবী। সেই কারণেই এই তিথিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয়। তবে দশমীকে ‘বিজয়া’ বলার কারণ খুঁজলে অনেক পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যাবে। পুরাণের মহিষাসুর বধ কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেনমা দুর্গা। তাই তাকে ‘বিজয়া’ বলা হয়। এছাড়াও শ্রীশ্রীচণ্ডী কাহিনী অনুসারে, দেবীর আবির্ভাব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। পরে শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধ করেছিলেন তিনি। তাই বিজয়া দশমী এই বিজয়াকেই চিহ্নিত করেন.
উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে তার অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কথিত আছে, রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, ও লক্ষণ। রাবণ বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যেই যুথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে.
তবে দুর্গাপুজোর শেষ দিন হিসাবে দশমী শোকের ছায়া বহন করলেও শাস্ত্রে এই বিষয়টিকে সেই ভাবে দেখা হয়নি। এপ্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। রানী রাসমণীর জামাতা মথুরবাবু একসময় আবেগপ্রবন হয়ে দশমীর দিনেও মা দুর্গাকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেন। তখন রামকৃষ্ণদেব তাঁকে বোঝান, বিজয়ার অর্থ দেবীমা ও সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। তিনি আরও বলেন যে, মা কখনও তার সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। এতদিন মা দালানে বসে পুজো নিয়েছেন এরপর মা হৃদয়মন্দিরে বসে পুজো নেবেন। এরপরেই মথুর শান্ত হন এবং বিসর্জন হয় মা দুর্গার প্রতিমা.
দশমীর আগে ‘বিজয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় কেন? কোন বিজয়কেই বা এটি চিহ্নিত করে?
দশমীকে ‘বিজয়া’ বলার কারণ খুঁজলে অনেক পৌরাণিক কাহিনী পাওয়া যাবে। পুরাণের মহিষাসুর বধ কাহিনীতে বলা হয়েছে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেন দেবী দুর্গা। তাই তাকে ‘বিজয়া’ বলা হয়। এছাড়াও শ্রীশ্রীচণ্ডী কাহিনী অনুসারে, দেবীর আবির্ভাব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। পরে শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর বধ করেছিলেন তিনি। তাই বিজয়া দশমী এই বিজয়াকেই চিহ্নিত করেন.
উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে দশেরা উদযাপিত হয়। তবে তার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। বাল্মীকি রামায়নে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, ও লক্ষণ। রাবণ বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যেই যুথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে.
সমাজে বিজয়া দশমীর প্রভাব কি?
বাঙালি হিন্দুবাড়িতে বিবাহিত কন্যারাও বিদায় নিয়ে স্বামীগৃহে চলে যান। এ ক্ষেত্রে দেবী দুর্গার বিদায় বেদনা ও কন্যার বিদায় বেদনা এক হয়ে যায়। বাঙালি হিন্দুরা মনে করেন, বিজয়া দশমীতে তারা কেবল দেবী দুর্গাকে বিদায় দিচ্ছেন না, যেন নিজের কন্যাকে বিদায় দিচ্ছেন। এভাবে দেবী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে যে নাইওরে এসে, তিন দিন থেকে চার দিনের দিন স্বামীগৃহে ফিরে যান। এভাবে পূজাপার্বণের মধ্যে বাঙালির সমাজ ও যাপিত জীবনের প্রতিফলনও ঘটে। বিজয়া দশমী এমনই একটি ধর্মীয় কৃত্য যার মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনের একটি দিকের প্রতিচ্ছায়া উপলব্ধি করা যায়.
বিজয়া দশমী হলো – সর্বসিদ্ধিদায়ক তিথি, তাই এই দিনকে সমস্ত মঙ্গল কাজের জন্য শুভ মনে করা হয়। এদিন দোকান বা বাড়ির নিমার্ণ, গৃহ প্রবেশ, অন্নপ্রাসন, নামকরণ, কর্ণ ছেদন, যজ্ঞোপবীত সংস্কার, ভূমি পুজো ইত্যাদি মঙ্গলকার্য করা যেতে পারে। তবে বিজয়াদশমীর দিন বিবাহসংস্কার করা উচিত নয়। মনে করা হয়, এদিন যে কাজ শুরু করা হয়, তা অবশ্যই সফল হয়। প্রাচীনকালে এদিনই রাজারা বিজয়কামনা করে রণযাত্রায় প্রস্থান করতেন।
বিজয়া দশমীর দিন কি করলে সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয় ?
দশহরা ও বিজয়াদশমীর দিন এই কয়েকটি কাজ করলে সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি হয় :-
- দশমী পুজোর অঞ্জলি দেওয়ার সময় সাদা বা নীল অপরাজিতা ফুল অর্পণ করুন.
- বিজয়া দশমীর দিন সকালে রাম মন্দিরে যান এবং সেখানে গিয়ে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালুন.
- দশমীর সকালে এক কৌটো সিঁদুর নিয়ে মায়ের মন্দিরে যান এবং সেই সিঁদুর থেকে কিছুটা মায়ের চরণে অর্পণ করে বাকিটা মায়ের চরণে ছুঁইয়ে বাড়ি নিয়ে চলে আসুন। সেই সিঁদুর সারা বছর পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে ব্যবহার করুন.
- সকালে দশমী পুজো হয়ে যাওয়ার পর মায়ের ঘটের কাছ থেকে একটি পদ্মফুল নিয়ে এসে হলুদ কাপড়ে মুড়ে বাড়ির দক্ষিণ-পুর্ব কোণে ঝুলিয়ে দিন.
- দশমীর দিনে বেসনের লাড্ডু কালো কুকুরকে খাওয়ান.
- দশমীর সকালে এক কৌটো সিঁদুর নিয়ে মায়ের মন্দিরে যান এবং সেই সিঁদুর থেকে কিছুটা মায়ের চরণে অর্পণ করে বাকিটা মায়ের চরণে ছুঁইয়ে বাড়ি নিয়ে চলে আসুন। সেই সিঁদুর সারা বছর পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে ব্যবহার করুন.
- প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যাওয়ার পর রাত্রিবেলা একটি পাত্রে কিছুটা চন্দন, অল্প সিঁদুর, অল্প কর্পূর, একটি পান এবং অল্প গোরোচনা নিয়ে একসঙ্গে বেটে একটি মিশ্রণ তৈরি করে নিন। তার পর ঘরের ভেতরে যে কোনও পবিত্র স্থানে সেই মিশ্রণের পাত্রটির সামনে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা রাত রেখে দিন। পরের দিন সকাল থেকে পর পর সাতদিন সেই মিশ্রণটি্র টিকা কপালে পরুন। অর্থভাগ্য ভালো হবে.
বিজয়া দশমীতে অস্ত্রপুজোর গুরুত্ব
আয়ুধ পুজো : অস্ত্রের আরাধনা – নবরাত্রির নবম দিনে অনুষ্ঠিত হয় আয়ুধ পুজো বা শস্ত্র পুজো।
তারপর দশম দিনে অস্ত্রগুলির সুব্যবহারের জন্যে দেবীর থেকে আশীর্বাদ নেওয়া হয়।
বিজয়াদশমী :-
এই আয়ুধপুজো অনুষ্ঠিত হয় সারা ভারত জুড়ে। ঐতিহ্যগত ভাবে এটি ছিলো অস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং অস্ত্রের ব্যবহারের প্রতি দায়বদ্ধ, যেমন রাজকীয় পরিবার বা মার্শাল আর্টের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের যেমন কালারিপাযাত্যু দের উৎসব! কিন্তু বর্তমানে অস্ত্র সাধারণত দেখা যায় পুলিশ,নিরাপত্তা রক্ষী এবং আর্মিদের হাতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ ইউনিটই বহুদিন ধরে অস্ত্রপুজো করে আসছে।
বিজয়াদশমীকে ঘিরে হিন্দুদের অস্ত্রপুজোর বহু ঐতিহ্য আছে। বিশেষত, এইদিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে এবং রাম রাবণকে বধ করেছিলেন। যদিও এতটা পরিচিত নয়, পাণ্ডবরা ১২ বছরের বনবাস এবং এক বছরের অজ্ঞাতবাসের পর এইদিনেই শমী গাছের কোটর থেকে তাদের অস্ত্র উদ্ধার করে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে, কর্ণাটকের মহারাজা এই দশম দিনে একটি সজ্জিত হাতির পিঠে চেপে মহীশূরের বান্নিমানতাপাতে যান, সেখানে একটি শমী গাছকে সম্মান জানানো হয়। মহীশূরের প্রধান রাস্তায় হওয়া এই শোভাযাত্রার জন্যই মহীশূরের দশেরা বিখ্যাত.
- [নতুন] Ishwar Chandra Vidyasagar Biography in Bengali – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনী
- [বিশ্লেষণ] বাংলার নবজাগরণ ছিল কলকাতা শহরকেন্দ্রিক
দেবী দুর্গা তো অমর। তাহলে তার আবার বিসর্জন কী? বিজয়ায় বিসর্জনের তাৎপর্য কী?
সনাতন ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে, মানুষের দেহ যেমন আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি এই পাঁচ উপাদান দিয়ে তৈরি তেমনি প্রতিমার ক্ষেত্রেও তাই। মাটির প্রাণহীন মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলে সেটি প্রতিমা হয়। আর পুজা শেষে দেবীকে বিদায়ের পর সেই প্রতিমাটি আবার প্রাণহীন মূর্তি হয়ে যায়। আর তাই তাকে আবার পঞ্চতত্ত্বের একটি, সেই জলেই বিসর্জন দেওয়া হয়। প্রতিমা পুজার সর্বশেষ ধাপ হল বিসর্জন।
জলের মাধ্যমেই মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়, সেই জন্যই আমরা গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। বিশেজ্ঞদের মতে আমাদের হৃদয়ে যে নিরাকার ঈশ্বর রয়েছেন, উপসনার জন্য মাটির প্রতিমা তৈরি করে তাকে সাকার রূপ দেওয়া হয়। পুজোর শেষে পুনরায় সেই সাকার রূপকে বিসর্জন দিয়ে নিরাকার ঈশ্বরকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া হয়। সেই কারণেই দুর্গা পূজার সময় যখন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তখন প্রার্থনা করা হয়, ‘তুমি আবার এসো আমাদের মাঝে’.
বিজয়া দশমীর গুরুত্ব
১. এটা বিশ্বাস করা হয় যে, শ্রীরামচন্দ্র এই দিন রাবণ বধের জন্যে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিলেন। সেই ঘটনাকে স্মরণ করেই এই দিন বিজয়া দশমী পালন করা হয়.
২. সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দিক্ষা গ্রহণের পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, “আজ থেকে আমি শস্ত্র এর পরিবর্তে শান্তি আর অহিংসা দিয়ে প্রতিটি প্রাণীর মন জয় করার ব্রত গ্রহণ করছি।” এই জন্য বিজয়া দশমী বৌদ্ধ জগত একে অশোক বিজয় দশমী হিসাবে পালন করেন.
৩. দশেরা বিজয়ের উৎসব।তাই এইদিন রাজা-মহারাজারা বিশেষ রীতিনীতি পালন করতেন। এটি ছিলো বিজয় এবং বীরত্বের অনুষ্ঠান! অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার আগে অর্জুন তাঁর সমস্ত অস্ত্রসস্ত্র গুলিকে একটি শমীগাছের কোটরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরে যখন কৌরবরা বিরাট রাজার গোশালা লুঠ করতে আসে তখন অর্জুন সেই কোটর থেকে অস্ত্রশস্ত্র বের করে করে এনে কৌরবদের পরাজিত করেন.
৪. বিজয়া দশমীর গুরুত্ব এবং শমীপুজো
পাণ্ডবরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র পাহারা দেওয়ার জন্য দুর্গাপুজোর সঙ্গে শমীগাছকেও পুজো করেছিলো। যেহেতু দিনটি ছিলো কৌরবদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়ের দিন‚ তাই দিনটি বিজয় দিবস হিসাবে পালিত হয় এবং শমী পুজোও বিজয়া দশমীর সঙ্গে পালিত হয়.
৫. পুরাকালে কৃষকেরা বছরের প্রথম ফসল তোলার পর দশেরার দিন খুশির উৎসব পালন করতো। নবরাত্রিতে‚ অর্থাৎ যেদিন ঘট স্থাপন করা হতো সেদিন নয় ধরনের খাদ্যশস্য নিয়ে একটি পাত্রের মধ্যে অঙ্কুরিত করা হতো। দশেরার দিন অঙ্কুরিত বীজগুলি দেবতাকে উৎসর্গ করা হতো। বিভিন্ন জায়গায় বাড়ির দরজাগুলিকে ধানের গোছা দিয়ে সাজানো হতো। যা নির্দেশ করে যে দশেরা আসলে কৃষকদের উৎসব ছিলো। বিজয়া দশমী চাষের সময়েরও সূচনা করে। সবাই এই দিনে ভালো শস্য‚ শান্তি এবং উন্নতির লক্ষ্যে ধরিত্রী মাতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করত.
৬. বিজয়া দশমীতে অস্ত্রপুজোর গুরুত্ব
আয়ুধ পুজো : অস্ত্রের আরাধনা – নবরাত্রির নবম দিনে অনুষ্ঠিত হয় আয়ুধ পুজো বা শস্ত্র পুজো।
তারপর দশম দিনে অস্ত্রগুলির সুব্যবহারের জন্যে দেবীর থেকে আশীর্বাদ নেওয়া হয়.
৭. মাধবাচার্য এবং বিজয়াদশমী
১২৩৮ সালে বিজয়া দশমীর দিন শ্রী মাধবাচার্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণ কর্ণাটকের উদুপি গ্রামের থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে অশ্বযুজ মাসে। তার পিতা ছিলেন ভাগবত সম্প্রদায়ের একজন ধার্মিক ব্রাহ্মণ, এবং পেশায় ছিলেন পৌরাণিক।
৮. ভেলু নাচিয়ার এবং কুইলি
১৮৫৭ সালেরও ৮৫ বছর আগে এই বীরাঙ্গনা বিজয়া দশমীর দিনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন.
৯. ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিন আরএসএসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণের প্রতি বীর সাভারকারের ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধা। তিনি এই দুইজনকে দেশের প্রধান সেনাপতি এবং সর্বাধিনায়ক বলে উল্লেখ করতেন। ১৯০৯ সালে তাঁর হাত ধরেই লন্ডনে প্রথম বিজয়া দশমী পালিত হয়। রামচন্দ্রের কাজকে স্মরণ করে তিনি বলতেন, ” শ্রীরামচন্দ্রের সিংহাসন ত্যাগের আপাত কারণ যদিও ছিলো পিতৃসত্য রক্ষা, কিন্তু তার আসল কারণ ছিলো রাক্ষস দমন। যখন তিনি লঙ্কা আক্রমণ করে রাবণ হত্যার জন্যে ধর্মযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর ভূমিকা ছিলো গৌরবোজ্জ্বল।”
১০. ১৯৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর, কর্ণাটকের দক্ষিণ কান্নাডা জেলার ম্যাঙ্গালুরুতে এ.বি.শেট্টির নেতৃত্বে একদল কৃষকের দ্বারা বিজয়া ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিজয়া দশমীর শুভদিনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে এর নাম হয়েছিল ‘বিজয়া ব্যাঙ্ক’.
১১. ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর নাগপুরের দীক্ষাভূমিতে এই বিজয়া দশমীর দিনে বাবা সাহেব আম্বেদকর বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। আজও সেই ঘটনা স্মরণ করে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
১২. সরস্বতী পুজো এবং বিদ্যারম্ভ
বিদ্যাশিক্ষা শুরুর জন্যে সরস্বতী পুজোর দিনটিকে শুভদিন মনে করা হয়। প্রধানত কর্ণাটক এবং কেরালাতে এই দিন থেকেই শিশুদের নাচ, গান, ভাষাশিক্ষা বা অন্যান্য লোকশিল্প শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। বাবা বা অন্য কোনো গুরুজনের সাহায্যে শিশুরা একটি প্লেটের উপর ধান বা বালি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর একটি মন্ত্র লিখে তাদের বিদ্যাশিক্ষার সূচনা করে।
১৩. বিজয়া দশমী এবং ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির
ঢাকাতে এই সময় ৫ দিন ধরে অনুষ্ঠান এবং ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দির এবং ঢাকার রামকৃষ্ণ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হওয়া উৎসবগুলির মধ্যে এটিই সবথেকে বড়।
১৪. ইউনেস্কো এবং বিজয়া দশমী
২০০৮ সালে বিজয়া দশমীকে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে ‘”Intangible Cultural Heritage of Humanity” বলে উল্লেখ করা হয়.
আমাদের শেষ কথা
তাই বন্ধুরা, আমি আশা করি আপনি অবশ্যই একটি Article পছন্দ করেছেন (বিজয়া দশমী কোন `বিজয়`কে চিহ্নিত করে? এই দিনের তাৎপর্য কি? বিজয়া দশমী পালনের মহত্ব কি? “দশমী” কথাটির অর্থ কি? দশমী কে বিজয়া বলা হয় কেন? সমাজে বিজয়া দশমীর প্রভাব কি?)। আমি সর্বদা এই কামনা করি যে আপনি সর্বদা সঠিক তথ্য পান। এই পোস্টটি সম্পর্কে আপনার যদি কোনও সন্দেহ থাকে তবে আপনাকে অবশ্যই নীচে মন্তব্য করে আমাদের জানান। শেষ অবধি, যদি আপনি Article পছন্দ করেন (বিজয়া দশমী), তবে অবশ্যই Article টি সমস্ত Social Media Platforms এবং আপনার বন্ধুদের সাথে Share করুন।